الرئيسية تعرف على الإسلام زاد الداعية إلى الله (بنغالي)

زاد الداعية إلى الله (بنغالي)

قراءة الكتاب
عرض المحتوى باللغة الأصلية

زاد الداعية إلى الله (بنغالي)

اللغة: بنغالي
إعداد: মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-উসাইমীন
نبذة مختصرة:
كتاب مترجم إلى اللغة البنغالية لفضلية الشيخ محمد بن صالح العثيمين - رحمه الله - تحدث فيه عن زاد الداعية من علم وصبر وحكمة وأخلاق وسماحة مع عرض أمثلة جميلة حية من سيرة المصطفى - صلى الله عليه وسلم -، والذي ينبغي للداعية أن يتصف به ليكون داعية ناجحا.

الوصف المفصل

আল্লাহর দিকে দাওয়াতের সম্বল

﴿ زاد الداعية إلى الله ﴾


সব প্রশংসা আল্লাহর, আমরা তাঁর প্রশংসা করছি, তারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি, তাঁর নিকট ক্ষমা চাচ্ছি, তাঁর কাছে তাওবা করছি। তাঁর কাছে আমাদের অন্তরের সব কলুষ ও সব পাপ কাজ থেকে পানাহ চাই। তিনি যাকে হিদায়াত দান করেন কেউ তাকে গোমরাহ করতে পারে না, আর তিনি যাকে পথ-ভ্রষ্ট করেন কেউ তাকে হিদায়াত দিতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে প্রেরণ করেছেন, যাতে তা সব দ্বীনের উপর বিজয় লাভ করে। তিনি তাঁর রিসালাহ (দাওয়াত) পৌঁছে দিয়েছেন, আমানত আদায় করেছেন, উম্মতকে উপদেশ দিয়েছেন, আল্লাহর পথে যথাযথ প্রচেষ্টা করেছেন। তাঁর উম্মতকে সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণের উপর রেখে গেছেন, যার দিবারাত্রি সমানভাবে উজ্জল, একমাত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত ছাড়া কেউ সে পথ থেকে সরে যায় না। তাই আল্লাহর সালাত ও সালাম তাঁর উপর, তাঁর পরিবার পরিজন, সাহাবীগণ ও কিয়ামত পর্যন্ত একনিষ্ঠার সাথে যারা তাঁর অনুসরণ করবে সকলের উপর বর্ষিত হোক। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাকে ও আপনাদেরকে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব কাজে তাঁর অনুসারী করেন, তিনি যেন তাঁর নবী (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) দলের অন্তর্ভুক্ত করে আমাদেরকে মৃত্যু দান করেন, তাঁর উম্মতের কাতারে যেন হাশরের দিনে একত্রিত করেন, তাঁর শাফায়াতের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং তিনি যেন আমাদেরকে চিরস্থায়ী জান্নাতে তাঁর সাথে ও সে সব নবী রাসূল, সিদ্দিকীন, শুহাদা ও সালেহীন বান্দাদের সাথে একত্রিত করেন যাদের উপর আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা,

এখানে (বাদশা আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়, জেদ্দায়) আমার মুসলিম ভাই ও বোনদের সাথে মিলিত হতে পেরে আমি গৌরবান্বিত ও আনন্দবোধ করছি। এ দ্বীনের প্রচার কাজে আশা করছি অন্য স্থানেও আপনাদের সাথে মিলিত হবো। কেননা আল্লাহ তা'আলা আলেমদের থেকে অঙ্গিকার নিয়েছেন যে, তাদেরকে যে ইলম দান করেছেন তা তারা মানুষের কাছে প্রচার করবে এবং তা গোপন করবে না। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,

﴿ وَإِذۡ أَخَذَ ٱللَّهُ مِيثَٰقَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ لَتُبَيِّنُنَّهُۥ لِلنَّاسِ وَلَا تَكۡتُمُونَهُۥ فَنَبَذُوهُ وَرَآءَ ظُهُورِهِمۡ وَٱشۡتَرَوۡاْ بِهِۦ ثَمَنٗا قَلِيلٗاۖ فَبِئۡسَ مَا يَشۡتَرُونَ ١٨٧ ﴾ [ال عمران: ١٨٧]

“আর স্মরণ কর, যখন আল্লাহ কিতাবপ্রাপ্তদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, 'অবশ্যই তোমরা তা মানুষের নিকট স্পষ্টভাবে বর্ণনা করবে এবং তা গোপন করবে না'। কিন্তু তারা তা তাদের পেছনে ফেলে দেয় এবং তা বিক্রি করে তুচ্ছ মূল্যে। অতএব তারা যা ক্রয় করে, তা কতইনা মন্দ!" [আলে ইমরান: ১৮৭]

আল্লাহর নেয়া এ অঙ্গিকার লিখিত ও মানুষের দৃশ্যমান কোন চুক্তিনামা নয়, বরং এটা এমন অঙ্গিকার যা আল্লাহ ঐ ব্যক্তি থেকে নিয়েছেন যাকে তিনি ইলম দান করেছেন। আল্লাহ তা'আলা এ অঙ্গিকার নারী পুরুষ সকলের কাছ থেকেই নিয়েছেন। সুতরাং যার কাছে আল্লাহর শরী'য়াতের ইলম আছে তাকে সে ইলম অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, সেটা যে স্থানেই হোক বা যে উপলক্ষ্যেই হোক।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা:

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো: “মহান আল্লাহ তা'আলার পথের দা'য়ীর পাথেয়"

প্রত্যেক মুসলমানের পাথেয় হলো যা আল্লাহ কুরআনে বর্ণনা করেছেন তা। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,

﴿ وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيۡرَ ٱلزَّادِ ٱلتَّقۡوَىٰۖ ١٩٧ ﴾ [البقرة: ١٩٧]

“এবং সম্বল গ্রহণ কর। নিশ্চয় উত্তম সম্বল হল তাকওয়া।" [সূরা আল-বাকারা: ১৯৭]

অতঃএব, প্রত্যেক মুসলমানের সম্বল হলো আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করা। এ তাকওয়া, তাকওয়া অবলম্বনকারীর প্রশংসা এবং সাওয়াবের কথা আল্লাহ তা'আলা কুরআনে বার বার বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,

﴿ ۞وَسَارِعُوٓاْ إِلَىٰ مَغۡفِرَةٖ مِّن رَّبِّكُمۡ وَجَنَّةٍ عَرۡضُهَا ٱلسَّمَٰوَٰتُ وَٱلۡأَرۡضُ أُعِدَّتۡ لِلۡمُتَّقِينَ ١٣٣ ٱلَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي ٱلسَّرَّآءِ وَٱلضَّرَّآءِ وَٱلۡكَٰظِمِينَ ٱلۡغَيۡظَ وَٱلۡعَافِينَ عَنِ ٱلنَّاسِۗ وَٱللَّهُ يُحِبُّ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ١٣٤ وَٱلَّذِينَ إِذَا فَعَلُواْ فَٰحِشَةً أَوۡ ظَلَمُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ ذَكَرُواْ ٱللَّهَ فَٱسۡتَغۡفَرُواْ لِذُنُوبِهِمۡ وَمَن يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ إِلَّا ٱللَّهُ وَلَمۡ يُصِرُّواْ عَلَىٰ مَا فَعَلُواْ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ١٣٥ أُوْلَٰٓئِكَ جَزَآؤُهُم مَّغۡفِرَةٞ مِّن رَّبِّهِمۡ وَجَنَّٰتٞ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَاۚ وَنِعۡمَ أَجۡرُ ٱلۡعَٰمِلِينَ ١٣٦ ﴾ [ال عمران: ١٣٣، ١٣٦]

“আর তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে, যার পরিধি আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। যারা সুসময়ে ও দুঃসময়ে ব্যয় করে এবং ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন। আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজদের প্রতি যুলম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা চায়। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে ? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তা তারা বার বার করে না। এরাই তারা, যাদের প্রতিদান তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতসমূহ যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর আমলকারীদের প্রতিদান কতই না উত্তম!" [আলে ইমরান: ১৩৩-১৩৬]

সম্মানিত ভাই ও বোনেরা:

আপনারা হয়ত বলবেন তাকওয়া কি?

জবাবে বলব: ত্বলক ইবন হাবীব রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “তাকওয়া হলো আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী সাওয়াবের প্রত্যাশায় তাঁর অনুগত্যের কাজ করা"। এ বাক্যে তাকওয়া বলতে ইলম, আমল, সাওয়াব ও শাস্তির ভয়কে একত্রিত করা হয়েছে।

আমরা সকলেই জানি যে, মহান আল্লাহ তা'আলার পথের দা'য়ীদের প্রকাশ্য ও গোপনে তাকওয়ার এ গুণ অবলম্বন করা খুবই প্রয়োজন। আমি এখানে আল্লাহ তা'আলার পথের দা'য়ীদের আল্লাহর সাহায্য পাওয়া ও তাদের যে সব সম্বল সংগ্রহ করা উচিত সেসব বিষয়ে আলোচনা করব।


প্রথম সম্বল

আল্লাহ পথের দা'য়ীরা যে দিকে মানুষকে ডাকবে সে সম্পর্কে ইলম তথা জ্ঞান থাকা

কুরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহের সঠিক জ্ঞান থাকা। কেননা এ দু' প্রকার ইলম ব্যতীত অন্যান্য ইলমকে প্রথমে কুরআন ও সুন্নাহের কষ্টিপাথরে যাচাই করতে হয়, যাচাইয়ে পর তা হয়ত কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হবে বা তা বিরোধী হবে। যদি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হয় তবে তা গ্রহণ করা হবে। আর কুরআন ও সুন্নার বিরোধী হলে তা যেই বলুক প্রত্যাখ্যান করা ফরয।

فقد ثبت عن ابن عباس رضي الله عنهما أنه قال: «يوشك أن تنزل عليكم حجارة من السماء أقول: قال رسول الله وتقولون: قال أبو بكر وعمر»

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু 'আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “সম্ভবত তোমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর নাযিল হলেও আমি বলব, এ কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অথচ তোমরা বলছ: আবু বকর ও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এরূপ বলেছেন।"

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথার বিপরীত আবু বকর ও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমার কথার ব্যাপারে যদি এরূপ সতর্কীকরণ করা হয় তবে যারা ইলম, তাকওয়া, রাসূলের সাহচর্য ও খিলাফতে তাদের চেয়ে অনেক কম মর্যাদাবান তাদের কথা গ্রহণের ক্ষেত্রে কিরূপ হবে?! অতএব তাদের কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কথা প্রত্যাখ্যান করা অধিক সমীচীন। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,

﴿ فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣ ﴾ [النور: ٦٣]

“অতএব যারা তাঁর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন নিজদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌঁছার ভয় করে।" [সূরা : আন্-নূর: ৬৩]

ইমাম আহমদ রহ. বলেছেন, তুমি কি জান ফিতনা কি? এখানে ফিতনা হলো শিরক। সম্ভবত কারো অন্তরে যখন কোন বক্রতা উদয় হয় ও তা কুরআন সুন্নাহ ব্যতীত অন্য কিছুর দিকে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে সে ধ্বংস হবে।

আল্লাহ পথের দা'য়ীর প্রথম সম্বল হবে আল্লাহর কিতাব আল কুরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহীহ ও গ্রহণযোগ্য হাদীসের ইলমের দ্বারা পাথেয় সংগ্রহ করা। ইলম ব্যতীত দাওয়াত অজ্ঞতাপূর্ণ দাওয়াত। আর অজ্ঞভাবে দাওয়াতের সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি। কেননা একজন দা'য়ী নিজে একজন পথপ্রদর্শক ও উপদেশ দাতা। আর সে দা'য়ী যদি অজ্ঞ হয় তবে সে নিজে পথ ভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরকেও পথ ভ্রষ্ট করবে। আল্লাহর কাছে আমরা এ কাজ থেকে পানাহ চাচ্ছি। তার অজ্ঞতা দু'টি অজ্ঞতাকে শামিল করে। আর যে অজ্ঞতা দু'টি অজ্ঞতাকে শামিল করে তা সাধারণ অজ্ঞতার চেয়ে মারাত্মক ও ক্ষতিকর। কেননা সাধারণ অজ্ঞতা ব্যক্তিকে কথা বলা থেকে বিরত রাখে, তবে শিক্ষার মাধ্যমে এ অজ্ঞতা দূরীভূত হয়। কিন্তু জাহলে মুরাক্কাব তথা না জেনে জানার ভান করাই হচ্ছে মারাত্মক ক্ষতিকর। কেননা এ ধরনের অজ্ঞরা কখনো চুপ থাকে না, বরং না জেনেও কথা বলতে থাকে। তখন তারা আলোকিত করার চেয়ে ধ্বংসই বেশি করে।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা:

ইলম ছাড়া আল্লাহর পথে আহ্বান করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার অনুসারীদের কাজের বিপরীত। আল্লাহ তাঁর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দিয়ে যা বলেছেন তা শুনুন। আল্লাহ বলেছেন,

﴿ قُلۡ هَٰذِهِۦ سَبِيلِيٓ أَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا۠ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِيۖ وَسُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ وَمَآ أَنَا۠ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ١٠٨ ﴾ [يوسف: ١٠٨]

“বল, এটা আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই''। [সূরা: ইউসুফ: ১০৮]

এখানে আল্লাহ বলেছেন,

﴿ أَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا۠ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِيۖ ١٠٨ ﴾

“আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও।" অর্থাৎ যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করে। সুতরাং আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতে হলে জেনে বুঝে দাওয়াত দিতে হবে, নিজে অজ্ঞ হয়ে নয়।

হে আল্লাহর পথের দা'য়ী!

তোমরা আল্লাহর এ বাণী ভালভাবে অনুধাবন করো।

﴿ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ

অর্থাৎ তিনটি বিষয়ে জেনে বুঝে দাওয়াত দাও।

প্রথমত: যে দিকে দাওয়াত দিবে সে ব্যাপারে দূরদর্শী হওয়া। যেমন: যে দিকে দাওয়াত দিবে সে ব্যাপারে শর'য়ী জ্ঞান থাকে। কেননা সে হয়ত কোন কাজ ফরয ভেবে সেদিকে আহ্বান করবে কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তা ফরয নয়। ফলে সে আল্লাহর বান্দাহর উপর অনাবশ্যকীয় জিনিসকে অত্যাবশ্যকীয় করে দিবে। আবার কখনও সে হারাম ভেবে তা থেকে বিরত থাকতে আহ্বান করবে, অথচ তা আল্লাহর দ্বীনে হারাম নয়, ফলে সে আল্লাহর হালালকৃত জিনিসকে হারাম করল।

দ্বিতীয়ত: দাওয়াতের অবস্থা সম্পর্কে দূরদর্শী হওয়া। এজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মু'য়ায রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ইয়ামানে প্রেরণ করেন তখন তাকে বলেছিলেন,

«إِنَّكَ سَتَأْتِي قَوْمًا أَهْلَ كِتَابٍ »

“তুমি আহলে কিতাবের এক সম্প্রদায়ের কাছে যাচ্ছ।" [1] তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে বলেছেন এবং এ জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। অতঃএব দা'য়ী যাদেরকে দাওয়াত দিবে তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানবে। তাদের ইলমী অবস্থা কি সে সম্পর্কে ভালভাবে জ্ঞাত হবে। তাদের তর্ক বিতর্ক করার দক্ষতা কি তাও জানবে যাতে প্রস্তুতি নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা ও বিতর্ক করা যায়। কেননা তুমি যখন এ ধরনের বিতর্কে লিপ্ত হবে তখন তোমাকে সত্যের বিজয়ের জন্য শক্তিশালী হতে হবে। কেননা সত্য বিজয় তখন তোমার দক্ষতার উপর নির্ভরশীল। তুমি কখনও এটা ভেবো না যে বাতিল শক্তি তোমার প্রতি সদয় হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّكُمْ تَخْتَصِمُونَ إِلَيَّ، وَلَعَلَّ بَعْضَكُمْ أَنْ يَكُونَ أَلْحَنَ بِحُجَّتِهِ مِنْ بَعْضٍ، فَأَقْضِيَ لَهُ عَلَى نَحْوٍ مِمَّا أَسْمَعُ مِنْهُ »

“উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা মামলা মুকাদ্দমা নিয়ে আমার কাছে আস এবং তোমাদের একজন অপরজন অপেক্ষা অধিক বাকপটূ হয়ে যুক্তি তর্কের মাধ্যমে স্বীয় দাবী প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। আমি কথা শুনে তার অনুকুলে রায় প্রদান করি"[2]

এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, বাদী বাতিল হলেও কখনও কখনও অন্যের চেয়ে অধিক বাকপটূ হয়ে যুক্তি তর্কের মাধ্যমে স্বীয় দাবী প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, ফলে বিচারক তার কথা শুনে তার অনুকূলে ফয়সালা দিয়ে থাকে। তাই যাদেরকে দাওয়াত দিবে তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানা আবশ্যক।

তৃতীয়ত: দাওয়াতের পদ্ধতি সম্পর্কে দূরদর্শী হওয়া। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,

﴿ ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ ﴾ [النحل: ١٢٥]

“তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহবান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর"[সূরা: আন-নাহাল: ১২৫]

কিছু মানুষ খারাপ কাজ দেখেই তা বন্ধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু ভবিষ্যতে তার ও তার মত অন্যান্য হকের প্রতি দা'য়ীদের উপর কি ফলাফল বর্তাবে তা নিয়ে চিন্তা করে না। এজন্যই দা'য়ীদের উচিত কোন আন্দোলনে নামার আগে তার ফলাফল কি হবে তা খেয়াল করা ও সে বিষয়ে অনুমান করা। সে সময় হয়ত তার প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে যা ইচ্ছা তা করল, কিন্তু পরবর্তীতে দা'য়ী ও অন্যান্যদের প্রভাবের কারণে চিরতরে কাজটি নির্বাপিত হয়ে যেতে পারে। এটা হয়ত শীঘ্রই বাস্তবায়িত হবে। এজন্যই আমি দা'য়ী ভাইদেরকে হিকমত ও ধীরস্থীরতার সাথে কাজ করতে উৎসাহিত করি। যদিও এতে কিছুটা বিলম্ব হয়, তথাপি শেষ পরিণাম হবে আল্লাহর ইচ্ছায় সুদূরপ্রসারী।

কুরআন ও সুন্নাহের সহীহ ইলমের সাহায্যে দা'য়ীর পাথেয় সংগ্রহ করা যেমন শর'য়ী বক্তব্যের চাহিদা তেমনি ভাবে এটা স্পষ্ট বিবেকেরও চাহিদা, যাতে কোন দ্বিধা সংশয় নেই। কেননা আপনার পথ জানা না থাকলে কিভাবে আল্লাহর পথে ডাকবেন? আপনি শরী'য়ত সম্পর্কে কিছু জানেন না, তাহলে কিভাবে আপনি দা'য়ী ইলাল্লাহ হবেন?

তাই মানুষের যদি ইলম না থাকে তবে সর্বপ্রথম তাকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, তারপরে আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকা উচিত।

কেউ হয়ত বলতে পারে, আপনার এ কথা কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিন্মোক্ত বাণীর সাথে বিরোধপূর্ণ নয়? «بلغوا عني ولو آية»

“তোমার কাছে আমার একটা আয়াত পৌঁছলেও তা মানুষের কাছে পৌঁছে দাও।"

জবাবে বলব: এটা বিরোধপূর্ণ নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও। তাহলে আমরা যা পৌঁছাবো তা অবশ্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হতে হবে। এটাই আমরা উদ্দেশ্য করেছি। আমরা যখন বলি যে, দা'য়ী ইলমের মুখাপেক্ষী, তখন আমাদের উদ্দেশ্য এটা নয় যে, তারা ইলম ছাড়াও অন্যান্য কিছু প্রচার করবে। বরং আমাদের উদ্দেশ্য হলো সে যা জানে তাই মানুষকে প্রচার করবে, যা জানে না সে সম্পর্কে কোন কথা বলবে না।


দ্বিতীয় সম্বল

দাওয়াতের ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করতে হবে।

সে যে দিকে ডাকে সে ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করা, দাওয়াতী কাজে যে বাধা আসবে সে ব্যাপারে ধৈর্য ধরা এবং দুঃখ-কষ্ট ও জুলুম-নির্যাতনে ধৈর্যধারণ করা।

দাওয়াতের ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করতে হবে, অবিরাম চালিয়ে যেতে হবে, দাওয়াত বন্ধ করা যাবে না এবং বিরক্ত হওয়া যাবে না। বরং সাধ্য অনুযায়ী আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াত চালিয়ে যেতে হবে। যে সব ক্ষেত্রে দাওয়াত বেশি ফলদায়ক, অগ্রগণ্য ও বেশি স্পষ্ট সে সব ক্ষেত্রে দাওয়াত দেয়া। দাওয়াতের কাজে ধৈর্যধারণ করা এবং ধৈর্যহারা ও বিরক্ত না হওয়া। কেননা মানুষ যখন ধৈর্যহারা ও বিরক্ত হয়ে যায় তখন সে নিরাশ হয়ে যায় এবং কাজটি ছেড়ে দেয়। কিন্তু দাওয়াত অবিরাম চালিয়ে গেলে একদিকে ধৈর্যশীলদের প্রতিদান পাবে আর অন্যদিকে শেষ পরিণাম শুভ হবে। আল্লাহ তাঁর নবীকে উদ্দেশ্য করে যে বাণী দিয়েছেন তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন:

﴿ تِلۡكَ مِنۡ أَنۢبَآءِ ٱلۡغَيۡبِ نُوحِيهَآ إِلَيۡكَۖ مَا كُنتَ تَعۡلَمُهَآ أَنتَ وَلَا قَوۡمُكَ مِن قَبۡلِ هَٰذَاۖ فَٱصۡبِرۡۖ إِنَّ ٱلۡعَٰقِبَةَ لِلۡمُتَّقِينَ ٤٩ ﴾ [هود: ٤٩]

“এগুলো গায়েবের সংবাদ, আমি তোমাকে ওহীর মাধ্যমে তা জানাচ্ছি। ইতঃপূর্বে তা না তুমি জানতে এবং না তোমার কওম। সুতরাং তুমি সবর কর। নিশ্চয় শুভ পরিণাম কেবল মুত্তাকীদের জন্য"[সূরা: হূদ: ৪৯]

দাওয়াতী কাজে মানুষ বিরোধীদের থেকে যে সব অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয় সে ব্যাপারে ধৈর্যশীল হওয়া অত্যাবশ্যক। কেননা যারাই আল্লাহর পথে দাওয়াত দিবে তারা অবশ্যই নিন্মোক্ত আয়াত অনুযায়ী জুলুম নির্যাতনের শিকার হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,

﴿ وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوّٗا مِّنَ ٱلۡمُجۡرِمِينَۗ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ هَادِيٗا وَنَصِيرٗا ٣١ ﴾ [الفرقان: ٣٠]

“আর এভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর জন্য অপরাধীদের মধ্য থেকে শত্রু বানিয়েছি। আর পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারী হিসেবে তোমার রবই যথেষ্ট।" [সূরা আল-ফুরকান: ৩০]

সুতরাং প্রত্যেক সত্যপন্থী দাওয়াতের বিরোধী দল থাকবেই। তারা নানা বাধা বিপত্তি, ঝগড়া ফ্যাসাদ ও সমস্যা সৃষ্টি করবে। কিন্তু দা'য়ীর উপর কর্তব্য হলো তারা দাওয়াতী কাজে এ সব বিরোধিতার উপর ধৈর্যধারণ করবে, এমনকি তারা যদি এ কথাও বলে যে, এটা ভ্রান্ত ও বাতিল দাওয়াত, তথাপিও সে ধৈর্যধারণ করবে; কারণ সে নিশ্চিতভাবে জানে যে, এটা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মোতাবেক সত্য দাওয়াত। অতঃএব, সে এতে ধৈর্য ধরবে ।

তবে এর অর্থ এটা নয় যে, তার কাছে সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরেও সে যা বলে ও দাওয়াত দেয় সেটার উপর অটল ও গোঁ ধরে থাকবে। কেননা যার কাছে সত্য স্পষ্ট ও প্রকাশিত হওয়ার পরেও সে (ভুল) দাওয়াতী কাজে জিদ ধরে থাকে তারা আল্লাহ বর্ণনাকৃত সে সব লোকের ন্যায়:

﴿ يُجَٰدِلُونَكَ فِي ٱلۡحَقِّ بَعۡدَ مَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُونَ إِلَى ٱلۡمَوۡتِ وَهُمۡ يَنظُرُونَ ٦ ﴾ [الانفال: ٦]

“তারা তোমার সাথে সত্য সম্পর্কে বিতর্ক করছে তা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর। যেন তাদেরকে মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নেয়া হচ্ছে, আর তারা তা দেখছে।" [সূরা : আল-আন্ফাল: ৬]

সত্যের ব্যাপারে বিতর্ক করা সম্পর্কে নিন্দা করা সত্বেও যারা বিতর্ক করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,

﴿ وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥ ﴾ [النساء: ١١٥]

“আর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তার জন্য হিদায়াত প্রকাশ পাওয়ার পর এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে ফেরাব যেদিকে সে ফিরে এবং তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর আবাস হিসেবে তা খুবই মন্দ"[সূরা : আন্-নিসা: ১১৫]

অতঃএব, দাওয়াতী কাজে নিজের বিরোধীদের কথা সত্য হলে দা'য়ীর উপর ফরয হলো সে নিজের মত থেকে সরে গিয়ে বিরোধীদের মত গ্রহণ করবে। আর যদি বিরোধীরা বাতিল হয় তবে দাওয়াতী কাজে নিজে অটল ও সুদৃঢ় থাকবে।

এমনিভাবে দা'য়ী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হলে ধৈর্যধারণ করবে। কেননা দা'য়ী অবশ্যই শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হবেই। আল্লাহর প্রেরিত নবী রাসূল আলাইহিমুস সালামরা শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন। মহান আল্লাহর নিন্মোক্ত বাণী পড়ুন:

﴿ كَذَٰلِكَ مَآ أَتَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِم مِّن رَّسُولٍ إِلَّا قَالُواْ سَاحِرٌ أَوۡ مَجۡنُونٌ ٥٢ ﴾ [الذاريات: ٥٢]

“এভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে যে রাসূলই এসেছে, তারা বলেছে, 'এ তো একজন জাদুকর অথবা উন্মাদ''। [সূরা : আয্-যারিয়াত: ৫২]

সুতরাং আপনার কি ধারণা যাদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী নাযিল হত তাদেরকে জাদুকর অথবা উন্মাদ বলা হত?! রাসূলগণ অবশ্যই শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিনের শিকার হয়েছিলেন। তা সত্বেও তারা ধৈর্যধারণ করেছিলেন।

প্রথম রাসূল নূহ আলাহিস সালামের দিকে লক্ষ্য করুন। তিনি কিশতি (নৌকা) তৈরি করার সময় তার সম্প্রদায়ের লোকজন তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় উপহাস করত আর বলত:

﴿ وَيَصۡنَعُ ٱلۡفُلۡكَ وَكُلَّمَا مَرَّ عَلَيۡهِ مَلَأٞ مِّن قَوۡمِهِۦ سَخِرُواْ مِنۡهُۚ قَالَ إِن تَسۡخَرُواْ مِنَّا فَإِنَّا نَسۡخَرُ مِنكُمۡ كَمَا تَسۡخَرُونَ ٣٨ فَسَوۡفَ تَعۡلَمُونَ مَن يَأۡتِيهِ عَذَابٞ يُخۡزِيهِ وَيَحِلُّ عَلَيۡهِ عَذَابٞ مُّقِيمٌ ٣٩ ﴾ [هود: ٣٨، ٣٩]

“আর সে নৌকা তৈরী করতে লাগল এবং যখনই তার কওমের নেতৃস্থানীয় কোন ব্যক্তি তার পাশ দিয়ে যেত, তাকে নিয়ে উপহাস করত। সে বলল, 'যদি তোমরা আমাদের নিয়ে উপহাস কর, তবে আমরাও তোমাদের নিয়ে উপহাস করব, যেমন তোমরা উপহাস করছ'। অতএব, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে, কার উপর সে আযাব আসবে যা তাকে লাঞ্ছিত করবে এবং কার উপর আপতিত হবে স্থায়ী আযাব।" [সূরা: হূদ: ৩৮-৩৯]

তারা শুধু উপহাস করেই ক্ষান্ত হয় নি, বরং তাকে হত্যার হুমকি দেন।

﴿ قَالُواْ لَئِن لَّمۡ تَنتَهِ يَٰنُوحُ لَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡمَرۡجُومِينَ ١١٦ ﴾ [الشعراء: ١١٦]

“তারা বলল, হে নূহ, তুমি যদি বিরত না হও তবে অবশ্যই তুমি প্রস্তরাঘাতে নিহতদের অন্তর্ভুক্ত হবে।" [সূরা : আশ-শু'আরা: ১১৬]

অর্থাৎ পাথরের আঘাতে নিহতদের অন্তর্ভুক্ত হবে। এখানে হুমকির সাথে হত্যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে যে, আমাদের প্রতাপের কারণে তোমার মত অন্যান্যদেরকে প্রস্তরাঘাতে আমরা হত্যা করেছি। তুমিও তাদের মত নিহত হবে। কিন্তু তাদের এ হুমকি ধমকি নূহ আলাইহিস সালামকে তার দাওয়াত থেকে বিরত রাখতে পারে নি। তিনি তার দাওয়াত চালিয়ে গেছেন। পরিশেষে আল্লাহ তা'আলা তাকে বিজয় দান করেছেন।

ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে তার সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রত্যাখ্যান করেছিল। এমনকি হত্যার জন্য তাকে মানুষের সামনে হাজির করেছিল।

﴿ قَالُواْ فَأۡتُواْ بِهِۦ عَلَىٰٓ أَعۡيُنِ ٱلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ يَشۡهَدُونَ ٦١ ﴾ [الانبياء: ٦١]

“তারা বলল, তাহলে তাকে লোকজনের সামনে নিয়ে এসো, যাতে তারা দেখতে পারে।'' [সূরা : আল-আম্বিয়া: ৬১]

অতঃপর তাকে আগুনে পুড়ে হত্যার অঙ্গিকার করে।

﴿ قَالُواْ حَرِّقُوهُ وَٱنصُرُوٓاْ ءَالِهَتَكُمۡ إِن كُنتُمۡ فَٰعِلِينَ ٦٨ ﴾ [الانبياء: ٦٨]

“তারা বলল, তাকে আগুনে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের দেবদেবীদেরকে সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও।'' [সূরা : আল-আম্বিয়া: ৬৮]

ফলে তারা আগুন প্রজ্বলিত করল এবং তাকে আগুনের কুন্ডলীর মধ্যে নিক্ষেপ করল যাতে আগুনের লেলিহানে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন,

﴿ قُلۡنَا يَٰنَارُ كُونِي بَرۡدٗا وَسَلَٰمًا عَلَىٰٓ إِبۡرَٰهِيمَ ٦٩ ﴾ [الانبياء: ٦٩]

“আমি বললাম, হে আগুন, তুমি শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও ইবরাহীমের জন্য।'' [সূরা : আল-আম্বিয়া: ৬৯]

ফলে আগুন শীতল ও শান্তিময় হয়ে গেল এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সেখান থেকে নিরাপদে রক্ষা পেলেন। পরিশেষে উত্তম পরিণাম ইবরাহীম আলাইহিস সালামেরই ছিল।

﴿ وَأَرَادُواْ بِهِۦ كَيۡدٗا فَجَعَلۡنَٰهُمُ ٱلۡأَخۡسَرِينَ ٧٠ ﴾ [الانبياء: ٧٠]

“আর তারা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছিল, কিন্তু আমি তাদেরকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম।" [সূরা : আল-আম্বিয়া: ৭০]

মূসা আলাহিস সালামকে ফিরাউন হত্যার হুমকি দিয়েছে।

﴿ وَقَالَ فِرۡعَوۡنُ ذَرُونِيٓ أَقۡتُلۡ مُوسَىٰ وَلۡيَدۡعُ رَبَّهُۥٓۖ إِنِّيٓ أَخَافُ أَن يُبَدِّلَ دِينَكُمۡ أَوۡ أَن يُظۡهِرَ فِي ٱلۡأَرۡضِ ٱلۡفَسَادَ ٢٦ ﴾ [غافر: ٢٦]

“আর ফির'আউন বলল, 'আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মূসাকে হত্যা করি এবং সে তার রবকে ডাকুক; নিশ্চয় আমি আশঙ্কা করি, সে তোমাদের দীন পাল্টে দেবে অথবা সে যমীনে বিপর্যয় ছড়িয়ে দেবে।" [সূরা : গাফের: ২৬]

ফলে সে মূসা আলাইহিস সালামকে হত্যার হুমকি দেয়, কিন্তু পরিশেষে উত্তম পরিণাম মূসা আলাইহিস সালামেরই ছিল।

﴿ وَحَاقَ بَِٔالِ فِرۡعَوۡنَ سُوٓءُ ٱلۡعَذَابِ ٤٥ ﴾ [غافر: ٤٥]

“আর ফির'আউনের অনুসারীদেরকে ঘিরে ফেলল কঠিন আযাব"[সূরা : গাফের: ৪৫]

ঈসা আলাইহিস সালামকে মানসিক নানা জুলুম নির্যাতন করা হয়েছে, এমনকি ইয়াহুদিরা তাকে জারজ সন্তান হিসেবে অপবাদ দিয়েছিল, তাদের ভ্রান্ত ধারণা মতে তারা তাকে হত্যা করেছে ও শূলে চড়িয়েছে।

কিন্তু আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,

﴿ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَٰكِن شُبِّهَ لَهُمۡۚ وَإِنَّ ٱلَّذِينَ ٱخۡتَلَفُواْ فِيهِ لَفِي شَكّٖ مِّنۡهُۚ مَا لَهُم بِهِۦ مِنۡ عِلۡمٍ إِلَّا ٱتِّبَاعَ ٱلظَّنِّۚ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينَۢا ١٥٧ بَل رَّفَعَهُ ٱللَّهُ إِلَيۡهِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمٗا ١٥٨ ﴾ [النساء: ١٥٧، ١٥٨]

“আর তারা তাকে হত্যা করেনি এবং তাকে শূলেও চড়ায়নি। বরং তাদেরকে ধাঁধায় ফেলা হয়েছিল। আর নিশ্চয় যারা তাতে মতবিরোধ করেছিল, অবশ্যই তারা তার ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে ছিল। ধারণার অনুসরণ ছাড়া এ ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞান নেই। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করেনি। বরং আল্লাহ তাঁর কাছে তাকে তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।" [সূরা : আন্-নিসা: ১৫৭-১৫৮]

ফলে তিনি তাদের থেকে রক্ষা পেলেন।

সর্বশেষ রাসূল, রাসূলগণের ইমাম ও আদম সন্তানের সর্দার মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নানা জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা তাঁর সম্পর্কে বলেন,

﴿ وَإِذۡ يَمۡكُرُ بِكَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لِيُثۡبِتُوكَ أَوۡ يَقۡتُلُوكَ أَوۡ يُخۡرِجُوكَۚ وَيَمۡكُرُونَ وَيَمۡكُرُ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ ٣٠ ﴾ [الانفال: ٣٠]

“আর যখন কাফিররা তোমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছিল, তোমাকে বন্দী করতে অথবা তোমাকে হত্যা করতে কিংবা তোমাকে বের করে দিতে। আর তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও ষড়যন্ত্র করেন। আর আল্লাহ হচ্ছেন ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে উত্তম।" [সূরা : আল-আন্ফাল: ৩০]

আল্লাহ তা'আলা তাঁর সম্পর্কে আরো বলেন,

﴿ وَقَالُواْ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِي نُزِّلَ عَلَيۡهِ ٱلذِّكۡرُ إِنَّكَ لَمَجۡنُونٞ ٦ ﴾ [الحجر: ٦]

“আর তারা বলল, 'হে ঐ ব্যক্তি, যার উপর কুরআন নাযিল করা হয়েছে, তুমি তো নিশ্চিত পাগল''। [সূরা: আল-হিজর: ৬]

﴿ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوٓاْ ءَالِهَتِنَا لِشَاعِرٖ مَّجۡنُونِۢ ٣٦ ﴾ [الصافات: ٣٦]

“আর বলত, 'আমরা কি এক পাগল কবির জন্য আমাদের উপাস্যদের ছেড়ে দেব?'' [সূরা : আস্-সাফ্ফাত: ৩৬]

তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ইতিহাসবিদদের নিকট স্পষ্ট। তা সত্বেও তিনি ধৈর্যধারণ করেছেন। ফলে শেষ পরিণাম তাঁরই ছিল।

তাহলে দেখা গেল, সব দা'য়ীরাই জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তারা সবাই ধৈর্যধারণ করেছেন। এজন্যই আল্লাহ তা'আলা যখন তার রাসূলকে বলেছেন,

﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡقُرۡءَانَ تَنزِيلٗا ٢٣ ﴾ [الانسان: ٢٣]

“নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি পর্যায়ক্রমে আল-কুরআন নাযিল করেছি।" [সূরা : আল্-ইনসান: ২৩]

এর পরে এ কথাই প্রত্যাশা করা হয় যে, আল্লাহ বলবেন: তাই আপনি এ কুরআন নাযিলের কারণে আল্লাহর নি'আমতের শুকরিয়া আদায় করুন। কিন্তু আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলেছেন,

﴿ فَٱصۡبِرۡ لِحُكۡمِ رَبِّكَ وَلَا تُطِعۡ مِنۡهُمۡ ءَاثِمًا أَوۡ كَفُورٗا ٢٤ ﴾ [الانسان: ٢٤]

“অতএব তোমার রবের হুকুমের জন্য ধৈর্য ধারণ কর এবং তাদের মধ্য থেকে কোন পাপিষ্ঠ বা অস্বীকারকারীর আনুগত্য করো না।" [সূরা : আল্-ইনসান: ২৪]

এর দ্বারা একথাই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যারাই এ কুরআনের খিদমত করবে তারা সবাই এমন সব জুলুম নির্যাতনের শিকার হবে যাতে মহা ধৈর্যধারণ করতে হবে। তাই দা'য়ীকে মহাধৈর্যশীল হতে হবে এবং দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। পরিশেষে আল্লাহ তাকে বিজয় দান করবেন। এটা জরুরী নয় যে, আল্লাহ তাকে তার জীবদ্দশায়ই বিজয় দিবেন, বরং মূলকথা হলো মানুষের মাঝে যুগে যুগে দাওয়াত চালু থাকা। এখানে ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, বরং দাওয়াতই মূখ্য উদ্দেশ্য। তার মৃত্যুর পরেও যদি দাওয়াত অবশিষ্ট থাকে এটাই সফলতা। কেননা আল্লাহ তা'য়ালা চিরঞ্জীব। তিনি বলেন,

﴿ أَوَ مَن كَانَ مَيۡتٗا فَأَحۡيَيۡنَٰهُ وَجَعَلۡنَا لَهُۥ نُورٗا يَمۡشِي بِهِۦ فِي ٱلنَّاسِ كَمَن مَّثَلُهُۥ فِي ٱلظُّلُمَٰتِ لَيۡسَ بِخَارِجٖ مِّنۡهَاۚ كَذَٰلِكَ زُيِّنَ لِلۡكَٰفِرِينَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٢٢ ﴾ [الانعام: ١٢٢]

“যে ছিল মৃত, অতঃপর আমি তাকে জীবন দিয়েছি এবং তার জন্য নির্ধারণ করেছি আলো, যার মাধ্যমে সে মানুষের মধ্যে চলে, সে কি তার মত যে ঘোর অন্ধকারে রয়েছে, যেখান থেকে সে বের হতে পারে না? এভাবেই কাফিরদের জন্য তাদের কৃতকর্ম সুশোভিত করা হয়"[সূরা : আল-আন'আম: ১২২]

প্রকৃতপক্ষে দা'য়ীর জীবন স্বশরীরে জীবিত থাকা মূল লক্ষ্য নয়, বরং তার প্রচেষ্টা ও কথাবার্তা মানুষের মাঝে অবশিষ্ট্য থাকাটাই লক্ষ্য।

হিরাক্লিয়াসের সাথে আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর ঘটনার প্রতি লক্ষ্য করুন। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের কথা আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আ'নহু থেকে জানলেন। তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব, বংশ, দাওয়াতী কার্যক্রম ও তাঁর সাহাবীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু 'আনহু তাকে এসব সম্পর্কে অবগত করালে হিরাক্লিয়াস তাকে বললেন,

فَإِنْ كَانَ مَا تَقُولُ حَقًّا فَسَيَمْلِكُ مَوْضِعَ قَدَمَيَّ هَاتَيْنِ

“তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয় তবে সে একদিন আমার পায়ের তলার এ দেশ পর্যন্ত বিজয় ও অধিকার করবেন"[3]

সুবহানাল্লাহ! কে ভাববে যে, একজন মহাসম্রাট মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলেছে অথচ তিনি তখনও আরব উপদ্বীপকে শয়তান ও খারাপ মনোবৃত্তি থেকে মুক্ত করেন নি। কেউ কি কখনও চিন্তা করেছে এ ব্যক্তি এ ধরনের উক্তি করেছে? এজন্যই আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু 'আনহু যখন সেখান থেকে বের হলেন তখন তিনি তাঁর সাথীদেরকে বললেন,

لَقَدْ أَمِرَ أَمْرُ ابْنِ أَبِي كَبْشَةَ، إِنَّهُ يَخَافُهُ مَلِكُ بَنِي الأَصْفَرِ.

“আমার মনে হয় আবু কাবশার পুত্রের মনোবাঞ্ছা যেন পুরা হয়ে যাবে। তাঁর মিশন এত শক্তিশালী হয়েছে যে, শ্বেতাঙ্গদের রাজা রোম সম্রাট পর্যন্ত তাঁকে ভয় করে"! এখানে «أمِر» অর্থ অনেক বড় হওয়া। যেমন আল্লাহর বাণীঃ

﴿ لَقَدۡ جِئۡتَ شَيًۡٔا إِمۡرٗا ٧١ ﴾ [الكهف: ٧١]

“আপনি অবশ্যই মন্দ কাজ করলেন''। [সূরা : আল-কাহফ: ৭১]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত হিরাক্লিয়াসের পায়ের তলার দেশ বিজয় ও অধিকার করেছিল, তিনি স্বশরীরে সে দেশ বিজয় করেন নি। কেননা তাঁর দাওয়াত সে দেশে পৌঁছেছিল এবং পৌত্তলিকতা, শিরক ও এর অনুসারীদেরকে ধুয়ে মুছে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করেছে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পরে খোলাফায়ে রাশেদিনগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত ও তাঁর শরি'য়াতের দ্বারা সেদেশ বিজয় করেছেন। সুতরাং দা'য়ীকে ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং সে যদি আল্লাহর পথে সত্যিকারে দাওয়াত দেয় তবে তার জীবদ্ধশায় বা মৃত্যুর পরে হলেও শেষ পরিণতি তারই হবে।

﴿ إِنَّ ٱلۡأَرۡضَ لِلَّهِ يُورِثُهَا مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦۖ وَٱلۡعَٰقِبَةُ لِلۡمُتَّقِينَ ١٢٨ ﴾ [الاعراف: ١٢٨]

“নিশ্চয় যমীন আল্লাহর। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে তিনি চান তাকে তার উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন। আর পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য"[সূরা : আল-আ'রাফ: ১২৮]

﴿ إِنَّهُۥ مَن يَتَّقِ وَيَصۡبِرۡ فَإِنَّ ٱللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجۡرَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٩٠ ﴾ [يوسف: ٩٠]

“নিশ্চয় যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে এবং সবর করে, তবে অবশ্যই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না"[সূরা: ইউসুফ: ৯০]

তৃতীয় সম্বল

হিকমত বা প্রজ্ঞা

হিকমতের সাথে দাওয়াত দিবে। প্রজ্ঞাহীনকে হিকমতের সাথে আহ্বান করতে হবে। আল্লাহর পথে দাওয়াত শুরু করতে হবে হিকমতের সাথে, অতঃপর সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে, তারপরে জালিম ব্যতীত অন্যান্যদের সাথে উত্তম পন্থায় বিতর্ক করে। তাহলে চারটি স্তরে দাওয়াত দিতে হবে।

﴿ ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ١٢٥ ﴾ [النحل: ١٢٥]

“তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহবান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন"[সূরা: আন-নাহাল: ১২৫]

আল্লাহ তা'আলা বলেছেন:

﴿ ۞وَلَا تُجَٰدِلُوٓاْ أَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ إِلَّا بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُ إِلَّا ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ مِنۡهُمۡۖ وَقُولُوٓاْ ءَامَنَّا بِٱلَّذِيٓ أُنزِلَ إِلَيۡنَا وَأُنزِلَ إِلَيۡكُمۡ وَإِلَٰهُنَا وَإِلَٰهُكُمۡ وَٰحِدٞ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُسۡلِمُونَ ٤٦ ﴾ [العنكبوت: ٤٦]

“আর তোমরা উত্তম পন্থা ছাড়া আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্ক করো না। তবে তাদের মধ্যে ওরা ছাড়া, যারা যুলুম করেছে। আর তোমরা বল, 'আমরা ঈমান এনেছি আমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে এবং তোমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো একই। আর আমরা তাঁরই সমীপে আত্মসমর্পণকারী''। [সূরা : আল্-আনকাবূত: ৪৬]

হিকমত হলো: কোন কিছু নিখুঁতভাবে ও দৃঢ়তার সাথে যথাস্থানে রাখা। তাড়াহুড়া করা হিকমত নয়। মানুষকে তার বর্তমান অবস্থা থেকে পরিবর্তন করে রাতারাতি সাহাবীদের জীবনাদর্শে রূপান্তরিত করতে চাওয়া কোন হিকমত নয়। আর যে ব্যক্তি এরূপ আশা করে সে নিছক মূর্খ, বোকা এবং প্রজ্ঞাহীন। কেননা আল্লাহর হিকমত এ ধরনের কাজ অস্বীকার করে। এর প্রমাণ হলো রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে কুরআন নাযিল হয়েছে যাতে মানুষের অন্তরে তা স্থির হয় ও পূর্ণতা পায়। হিজরতের তিন বছর পূর্বে মিরাজের রাত্রিতে সালাত ফরয হয়েছে। কারো মতে হিজরতের দেড় বছর বা পাঁচ বছর পূর্বে। এতদসত্ত্বেও বর্তমান অবস্থায় আমরা যেভাবে সালাত আদায় করি তখন সেভাবে পূর্ণরূপে সালাত ফরয হয়নি। প্রথমে যোহর, আসর, ইশা ও ফজরে দু'রাক'আত করে সালাত ফরয ছিল। মাগরিবে তিন রাক'আত ফরয ছিল, যেন তা দিনের বেজোড় হয়। রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তের বছর মক্কায় কাটানোর পর হিজরতের পরে মুকিম অবস্থায় সালাতের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। ফলে যোহর, আসর ও ইশায় চার রাক'আত ফরয করা হয় এবং ফজরে দু'রাক'আত পূর্বের মতই অবশিষ্ট থাকে। কেননা ফজরে কিরাত দীর্ঘ করা হয়। মাগরিবে তিন রাক'আতই থাকে, কেননা তা দিনের বেজোড় সালাত।

দ্বিতীয় হিজরীতে যাকাত ফরয হয়। কারো মতে যাকাত মক্কায় ফরয হয়। কিন্তু তখন যাকাতের নিসাব ও হকদার কিছুই ফরয হয়নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাত আদায়ের জন্য নবম হিজরীর আগে কোন প্রতিনিধি প্রেরণ করেন নি। যাকাত আদায়ের তিনটি ধাপ অতিবাহিত হয়েছে। মক্কায় ফরয হয়েছে,

﴿ ۞ وَءَاتُواْ حَقَّهُۥ يَوۡمَ حَصَادِهِۦۖ ١٤١ ﴾ [الانعام: ١٤١]

“এবং ফল কাটার দিনেই তার হক দিয়ে দাও"[সূরা : আল-আন'আম: ১৪১]

তখন ফরযের বিধান ও পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় নি। বিষয়টি মানুষের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরীতে যাকাতের নিসাব ও হকদার সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। নবম হিজরীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পশু ও শস্যের মালিকদের কাছে যাকাত আদায়ের জন্য প্রতিনিধি প্রেরণ করেন।

আহকামুল হাকেমীন মহান আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক শরী'য়ত প্রণয়নে মানুষের অবস্থা কিভাবে লক্ষ্য করা হয়েছে তা নিয়ে একটু ভাবুন। এমনিভাবে সিয়ামের বিধান ক্রমবিকাশে মানুষের অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখা হয়েছে। প্রথমে সিয়াম পালন করা বা সিয়ামের পরিবর্তে লোকদেরকে খাদ্য দেয়ার ব্যাপারে মানুষকে ইখতিয়ার দেয়া হয়েছিল। অতঃপর সবার জন্য সিয়াম ফরয করা হয়। আর যারা সিয়াম পালনে অক্ষম শুধু তাদের ক্ষেত্রে সিয়ামের পরিবর্তে খাদ্য প্রদানের বিধান বহাল থাকে।

আমি বলব, রাতারাতি বিশ্বকে পরিবর্তন করা হিকমতের পরিপন্থী। অবশ্যই এতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হবে। প্রথমে আপনি আপনার ভাই বর্তমান যে মতের উপর আছে তা সত্য মনে করে তার কাছে দাওয়াত নিয়ে যান, আস্তে আস্তে তার ভুল ভ্রান্তি শুধরিয়ে দেন। তবে সব মানুষ এক রকম নয়। অজ্ঞ ও সত্যকে অস্বীকারকারীর মধ্যে তফাত আছে।

এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতের কিছু নমুনা দেয়াটা উপযোগী মনে করছি।

প্রথম উদাহরণ:

এক বেদুঈন ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদে (মসজিদে নববী) প্রবেশ করল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে নিয়ে মসজিদে বসে ছিলেন। বেদুঈনটি মসজিদের এক পাশে পেশাব করল। সাহাবীগণ তাকে কঠোরভাবে ধমক দিল। কিন্তু আল্লাহর হিকমত প্রাপ্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে পেশাব করতে বারণ না করে লোকদেরকে ধমক দিতে বারণ করলেন। বেদুঈন লোকটি পেশাব শেষ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেন লোকটির পেশাবের উপর এক বালটি পানি ঢেলে দিতে। ফলে মসজিদ থেকে ময়লা দূর হলো এবং পবিত্র হয়ে গেল। আর বেদুঈন লোকটিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডেকে বললেন:

«إِنَّ هَذِهِ الْمَسَاجِدَ لَا تَصْلُحُ لِشَيْءٍ مِنْ هَذَا الْبَوْلِ، وَلَا الْقَذَرِ إِنَّمَا هِيَ لِذِكْرِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَالصَّلَاةِ وَقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ»

“মসজিদসমূহে কষ্টদায়ক ও অপবিত্রকর কিছু করা উচিত নয়, এগুলো নামায ও কুরআন তিলাওয়াতের স্থান"[4]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ সুন্দর আচরণ লোকটির হৃদয় গলে গেল। এজন্যই কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে লোকটি বলল:

«اللهم ارحمني ومحمداً ولا ترحم معنا أحداً»

“ইয়া আল্লাহ! আমাকে ও মুহাম্মদকে দয়া করো, আমাদের সাথে কাউকে দয়া করো না"

কেননা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে সুন্দর আচরণ করেছেন। পক্ষান্তরে সাহাবীগণ অজ্ঞ লোকটির অবস্থা না বুঝে অন্যায় কাজ দূর করতে এগিয়ে এসেছিল যা হিকমতের পরিপন্থী ছিল।

দ্বিতীয় উদাহরণ: মু'আবিয়া ইবনুল হাকাম রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর ঘটনা।

عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ الْحَكَمِ السُّلَمِيِّ، قَالَ: بَيْنَا أَنَا أُصَلِّي مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، إِذْ عَطَسَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ، فَقُلْتُ: يَرْحَمُكَ اللهُ فَرَمَانِي الْقَوْمُ بِأَبْصَارِهِمْ، فَقُلْتُ: وَاثُكْلَ أُمِّيَاهْ، مَا شَأْنُكُمْ؟ تَنْظُرُونَ إِلَيَّ، فَجَعَلُوا يَضْرِبُونَ بِأَيْدِيهِمْ عَلَى أَفْخَاذِهِمْ، فَلَمَّا رَأَيْتُهُمْ يُصَمِّتُونَنِي لَكِنِّي سَكَتُّ، فَلَمَّا صَلَّى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَبِأَبِي هُوَ وَأُمِّي، مَا رَأَيْتُ مُعَلِّمًا قَبْلَهُ وَلَا بَعْدَهُ أَحْسَنَ تَعْلِيمًا مِنْهُ، فَوَاللهِ، مَا كَهَرَنِي وَلَا ضَرَبَنِي وَلَا شَتَمَنِي، قَالَ: «إِنَّ هَذِهِ الصَّلَاةَ لَا يَصْلُحُ فِيهَا شَيْءٌ مِنْ كَلَامِ النَّاسِ، إِنَّمَا هُوَ التَّسْبِيحُ وَالتَّكْبِيرُ وَقِرَاءَةُ الْقُرْآنِ» أَوْ كَمَا قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ»

মু'আবিয়া ইবনুল হাকাম আস-সুলামী রাদিয়াল্লাহু 'আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম এর সঙ্গে সালাত আদায় করেছিলাম। ইত্যবসরে আমাদের মধ্যে একজন হাঁচি দিল। আমি ইয়ারহামুকাল্লহ বললাম। তখন লোকেরা আমার দিকে আড়চোখে দেখতে লাগল। আমি বললাম “তার মায়ের পূত্র বিয়োগ হোক"। তোমরা আমার প্রতি তাকাচ্ছ কেন? তখন তারা তাদের উরুর উপর হাত চপড়াতে লাগল। আমি যখন বুঝতে পারলাম যে, তারা আমাকে চুপ করাতে চাচ্ছে, তখন আমি চুপ হয়ে গেলাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম সালাত শেষ করলেন, আমার মাতা-পিতা তাঁর জন্য কুরবান হোক! আমি তার মত এত সুন্দর করে শিক্ষা দিতে পূর্বেও কাউকে দেখিনি, তাঁরপরেও কাউকে দেখি নি। আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে ধমক দিলেন না, মারলেন না, গালিও দিলেন না। বরং বললেন, “সালাতে কথা কথাবার্তা বলা ঠিক নয়। বরং তা হচ্ছে- তাসবীহ, তাকবীর ও কুরআন পাঠের জন্য"[5]

হাদীসে বর্ণিত, واثكل أمِّياه “তার মায়ের পুত্র বিয়োগ হোক", বাক্যটি শুধু মুখে উচ্চারণ করা হয়, কিন্তু এর আসল অর্থ উদ্দেশ্য নেয়া হয় না। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একথাটি মু'য়ায ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু 'আনহুকে বলেছিলেন,

«أَلاَ أُخْبِرُكَ بِمَلاَكِ ذَلِكَ كُلِّهِ؟ قُلْتُ: بَلَى يَا نَبِيَّ اللهِ، فَأَخَذَ بِلِسَانِهِ قَالَ: كُفَّ عَلَيْكَ هَذَا، فَقُلْتُ: يَا نَبِيَّ اللهِ، وَإِنَّا لَمُؤَاخَذُونَ بِمَا نَتَكَلَّمُ بِهِ؟ فَقَالَ: ثَكِلَتْكَ أُمُّكَ يَا مُعَاذُ، وَهَلْ يَكُبُّ النَّاسَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوهِهِمْ أَوْ عَلَى مَنَاخِرِهِمْ إِلاَّ حَصَائِدُ أَلْسِنَتِهِمْ».

“এরপর বললেন: এ সব কিছুর মূল পুঁজি সম্পর্কে তোমাকে অবহিত করব কি? আমি বললাম: অবশ্যই, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি তাঁর জিহ্বা ধরে বললেন: এটিকে সংযত রাখ। আমি বললাম: হে আল্লাহর নবী! আমরা যে কথাবার্তা বলি সেই কারণেও কি আমাদের পাকড়াও করা হবে? তিনি বললেন: তোমাদের মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক, হে মু'আয! লোকদের অধ:মুখে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার জন্য এই যবানের কামাই ছাড়া আর কি কিছু আছে নাকি?" [6]

এ হাদীসের প্রতি লক্ষ্য করুন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে লোকদেরকে দাওয়াত দিয়েছেন যা মানুষের অন্তর প্রশস্ত হয়ে গেছে এবং তারা উদার চিত্তে সে দাওয়াত কবুল করেছেন।

এ হাদীস থেকে আমরা ফিকহী কিছু মাস'য়ালা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। তাহলো: কেউ যদি না জেনে সালাতে কথা বলে তবে তার সালাত শুদ্ধ।

তৃতীয় উদাহরণ:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: هَلَكْتُ، يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: «وَمَا أَهْلَكَكَ؟» قَالَ: وَقَعْتُ عَلَى امْرَأَتِي فِي رَمَضَانَ، قَالَ: «هَلْ تَجِدُ مَا تُعْتِقُ رَقَبَةً؟» قَالَ: لَا، قَالَ: «فَهَلْ تَسْتَطِيعُ أَنْ تَصُومَ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ؟» قَالَ: لَا، قَالَ: «فَهَلْ تَجِدُ مَا تُطْعِمُ سِتِّينَ مِسْكِينًا؟» قَالَ: لَا، قَالَ: ثُمَّ جَلَسَ، فَأُتِيَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِعَرَقٍ فِيهِ تَمْرٌ، فَقَالَ: «تَصَدَّقْ بِهَذَا» قَالَ: أَفْقَرَ مِنَّا؟ فَمَا بَيْنَ لَابَتَيْهَا أَهْلُ بَيْتٍ أَحْوَجُ إِلَيْهِ مِنَّا، فَضَحِكَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى بَدَتْ أَنْيَابُهُ، ثُمَّ قَالَ: «اذْهَبْ فَأَطْعِمْهُ أَهْلَكَ»

“আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু 'আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের নিকট এসে বললেন হে আল্লাহর রাসুল! আমি ধ্বংস হয়ে গিয়েছি। তিনি বললেন কিসে তোমাকে ধ্বংস করেছে? সে বলল আমি রময়াদান মাসে সওমরত অবস্হায় আমার স্ত্রীর সাথে সহবাস করেছি। তিনি বললেন তোমার কোন ক্রীতদাস আছে কি যাকে তুমি আযাদ করে দিতে পার? সে বলল, না । তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কি ক্রমাগত দুই মাস সওম পালন করতে পারবে? সে বলল, না। পুনরায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম তাকে বললেন, তুমি ষাটজন মিসকীনকে খাওয়াতে পারবে কি? সে বলল, না । তারপর সে বসে গেল। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের নিকট এক টুকরি খেজুর আনা হল। তিনি লোকটিকে বললেন এগুলো সদকা করে দাও। তখন সে বলল আমার চেয়েও অভাবী লোককে সদকা করে দিব? (মদীনার) দুটি কংকরময় ভূমির মধ্যস্হিত স্থানে আমার পরিবারের চেয়ে অভাবী পরিবার আর একটিও নেই। এ কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম হেসে দিলেন। এমনকি তাঁর সামনের দাঁতগুলো প্রকাশ হয়ে পড়ল। তখন তিনি বললেন, তাহলে যাও এবং তোমার পরিবারকে খেতে দাও"[7]

ফলে লোকটি ইসলাম ধর্মের প্রতি ও এ ধর্মের সর্বপ্রথম দা'য়ী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহজ সরলতায় মুগ্ধ হয়ে প্রশান্ত চিত্তে হাসি খুশী মুখে ফিরে গেল। আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন।

চতুর্থ উদাহরণ: এ হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন গুনাহগারের সাথে কিভাবে আচরণ করেছেন তা লক্ষ্য করুন।

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى خَاتَمًا مِنْ ذَهَبٍ فِي يَدِ رَجُلٍ، فَنَزَعَهُ فَطَرَحَهُ، وَقَالَ: «يَعْمِدُ أَحَدُكُمْ إِلَى جَمْرَةٍ مِنْ نَارٍ فَيَجْعَلُهَا فِي يَدِهِ»، فَقِيلَ لِلرَّجُلِ بَعْدَ مَا ذَهَبَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خُذْ خَاتِمَكَ انْتَفِعْ بِهِ، قَالَ: لَا وَاللهِ، لَا آخُذُهُ أَبَدًا وَقَدْ طَرَحَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ

“আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে দেখলেন সে সোনার আংটি পরিধান করেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে আংটিটি খুলে নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর তিনি বললেন:

«يَعْمِدُ أَحَدُكُمْ إِلَى جَمْرَةٍ مِنْ نَارٍ فَيَجْعَلُهَا فِي يَدِهِ»

“কেউ কি ইচ্ছাকৃতভাবে আগুনের এক টুকরা পাথর নিয়ে হাতে পরিধান করবে?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে রূঢ় আচরণ করেন নি। বরং তিনি নিজ হাতে আংটিটি যমিনে নিক্ষেপ করে ফেলে দিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে গেলে তাকে বলা হলো: “তুমি তোমার আংটিটি নাও। সে তখন বলল: “আল্লাহর কসম, যে আংটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিক্ষেপ করে ফেলে দিয়েছেন সে আংটি আমি নিবো না"[8]

আল্লাহু আকবর। এটা ছিল সাহাবীদের তাৎক্ষণিক আমলের নমুনা। রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন।

মূলকথা হলো, দা'য়ীকে হিকমতের সাথে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিতে হবে।

তবে অজ্ঞ ব্যক্তি আলেমের মত নয়, অস্বীকারকারী আত্মসমর্পণকারীর মত নয়। প্রত্যেক স্তরের লোকের জন্য আলাদা আলাদা কথা এবং মর্যাদা ও অবস্থা অনুসারে তাকে সে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে হবে।


চতুর্থ সম্বল

দা'য়ীকে উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান হতে হবে।

দা'য়ীর চরিত্রে ইলমের প্রভাব তার ঈমান, ইবাদাত, স্বভাব ও সব ধরনের আচরণে পরিলক্ষিত হতে হবে। সে যেন আল্লাহর পথে সত্যিকার দা'য়ীর নমুনা হয়। আর যদি দা'য়ী তার আমলের বিপরীত হয় তবে শীঘ্রই তার দাওয়াত ব্যর্থ হবে, যদিও সাময়িক কিছু দিনের জন্য সফল হতে পারে।

অতঃএব, ইবাদাত, লেনদেন, স্বভাব চরিত্র ও চলাফেরা ইত্যাদি যেসব দিকে দা'য়ী দাওয়াত দিবে সে সব ব্যাপারে তাকে উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান হতে হবে যাতে সে গ্রহণযোগ্য দা'য়ী হয় এবং সে যেন প্রথম জাহান্নামী না হয়।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা:

আমরা আমাদের বাস্তব অবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে দেখি যে, আমরা দাওয়াত দেই এক দিকে কিন্তু আমরা সে কাজটি করি না। এটা অবশ্যই অনেক বড় বিভ্রাট ও গলদ। তবে হ্যাঁ, যদি আমাদের মাঝে ও তার মাঝে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকে যা অধিক যুক্তিসঙ্গত। কেননা প্রত্যেক স্থান ও অবস্থাভেদে কথা বলতে হয়। কখনও কখনও ক্ষেত্র বিশেষ উত্তম জিনিস তুলনামূলক ভালোয় পরিণত হয়, আবার তুলনামূলক ভাল জিনিস উত্তম জিনিসে পরিণত হয়। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝে মাঝে কিছু গুণের দিকে আহ্বান করতেন, অথচ তিনি এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি মাঝে মাঝে এমনভাবে সাওম পালন করতেন দেখলে মতে হতো তিনি কখনো সাওম ছাড়া থাকেন না। আবার মাঝে মাঝে এমনভাবে সাওম ছাড়া থাকতেন দেখলে মনে হতো তিনি যেন সাওম পালন করেন না।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা!

আমি দা'য়ীকে এমনসব উত্তম আখলাকে চরিত্রবান হতে বলি যা একজন দা'য়ীর জন্য খুবই জরুরী, যাতে সে সত্যিকারের দা'য়ী হতে পারে। তার কথা যেন মানুষ গ্রহণ করে।


পঞ্চম সম্বল
দা'য়ীকে জড়তা ও প্রতিবন্ধকতা পরিহার করা।

যেসব জড়তা ও প্রতিবন্ধকতা দাওয়াতের ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। কেননা অনেক দা'য়ী ভাইদেরকে দেখেছি তারা মানুষের মাঝে অসৎ কাজ দেখলে তাদের মধ্যে একধরনের অহমিকা ও অপছন্দ সৃষ্টি হয়, ফলে তারা তার কাছে যায় না এবং তাকে ভাল উপদেশও দেয় না। অথচ এরূপ করা কখনো হিকমতপূর্ণ নয়। বরং হিকমত হলো তার কাছে গিয়ে তাকে দাওয়াত দেয়া ও তাকে এ কাজের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করা। এ কথা কখনো বলবেন না যে, তারা ফাসিক ফুজ্জার, সুতরাং তাদের আশে পাশে যাওয়া যাবে না। তাহলে হে দা'য়ী ভাই, আপনি যদি তাদের পাশে না যান এবং তাদেরকে দাওয়াত না দেন তাহলে কে এ দায়িত্ব নিবে? তাহলে অসৎ কাজ সম্পাদনকারী কেউ কি তাদের দায়িত্ব নিবে? অজ্ঞ লোকেরা কি এ কাজের দায়ভার নিবে? না, কখনও না। এজন্যই দা'য়ীকে ধৈর্য ধরতে হবে। এ ধৈর্যের কথাই ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। নিজে ধৈর্য ধরবে এবং মনে মনে অন্যায় কাজটি ঘৃণা করবে।

মানুষের মাঝে দাওয়াতের ক্ষেত্রে জড়তা ও প্রতিবন্ধকতা ভেঙ্গে ফেলতে হবে, যাতে যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছানো দরকার তাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছাতে পারে। পক্ষান্তরে তাদেরকে অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের বিপরীত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্বের মৌসুমে মিনায় অবস্থানের দিনে মুশরিকদের কাছে গিয়ে তাদেরকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে দাওয়াত দিতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে, তিনি মানুষের মাঝে দাওয়াত দিতে নিজেকে পেশ করতেন,

" هَلْ مِنْ رَجُلٍ يَحْمِلُنِي إِلَى قَوْمِهِ، فَإِنَّ قُرَيْشًا قَدْ مَنَعُونِي أَنْ أُبَلِّغَ كَلَامَ رَبِّي "

“কেউ কি আছে যে আমাকে তার সম্প্রদায়ের কাছে নিয়ে যাবে (তাদের মাঝে আমি দাওয়াত দিব), কেননা কুরাইশরা আমাকে আল্লাহর বাণী প্রচারে বাধা দেয়"[9]

এরূপ ঐকান্তিকতা ও অধ্যবসায় যখন আমাদের নবী, ইমাম ও মডেল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের, তাহলে আমাদের উপর ফরয হলো আমরা তাঁর মতো হয়ে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিব।


ষষ্ঠ সম্বল
দা'য়ীর অন্তর বিরোধীদের প্রতি উদার হতে হবে।

বিশেষ করে যখন জানা যাবে যে, তার বিরোধীদের উদ্দেশ্য ভালো এবং সে যদি দলিল প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই বিরোধীতা করে তবে এসব ক্ষেত্রে নমনীয় হতে হবে। এ সব বিতর্ক যেন ঝগড়া ফাসাদের পর্যায়ে না পৌঁছে সে খেয়াল রাখতে হবে। তবে হ্যাঁ, ব্যক্তি যদি সত্যে স্পষ্ট হওয়ার পরেও বাতিলের উপর দৃঢ় থেকে শুধুই বিরোধিতা ও অস্বীকার করার উদ্দেশ্যে বিতর্ক করে তবে তার আচরণ অনুযায়ী তাঁর সাথে সে ধরনের আচরণ করতে হবে, যাতে মানুষ তার থেকে ভেগে যায় এবং সতর্ক হতে পারে। কেননা তার শত্রুতা প্রকাশ পক্ষান্তরে সত্যকেই প্রকাশ।

এখানে কিছু প্রাসঙ্গিক মাস'য়ালা আছে। তাহলো বাস্তবিক পক্ষে আল্লাহ তা'আলা বান্দাহদের উপর প্রশস্ত করেছেন অর্থাৎ যেসব মাস'য়ালা উসুল নয়, সেগুলোর ব্যাপারে বিরোধীকে কাফির বলা যাবে না। এটা আল্লাহ বান্দাহর উপর প্রশস্ত করেছেন। এখানে ভুলকে তিনি অনেক প্রশস্ত করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«إِذَا حَكَمَ الحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ، وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ»

“কোন বিচারক ইজতিহাদে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে তার জন্য রয়েছে দু'টি পুরস্কার। আর যদি কোন বিচারক ইজতিহাদে ভুল করেন তার জন্যও রয়েছে একটি পুরস্কার"[10]

সুতরাং মুজতাহিদ সর্বাবস্থায় পুরস্কার পাবে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে দুটি পুরস্কার আর ভুল হলে একটি পুরস্কার পাবে। আপনি যেমন চান না যে, মানুষ যেন আপনার বিরোধিতা না করুক, তেমনিভাবে আপনার বিরোধীরাও চায় কেউ যেন তার বিরোধিতা না করে। আপনি যেমন চান মানুষ আপনার কথা মেনে চলুক, তেমনিভাবে আপনার বিরোধীরাও চায় যে, তাদের কথা মানুষ মেনে চলুক। বিরোধের সময় আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক বর্ণিত ফয়সালাই একমাত্র ভরসা। আল্লাহ বলেছেন,

﴿ وَمَا ٱخۡتَلَفۡتُمۡ فِيهِ مِن شَيۡءٖ فَحُكۡمُهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِۚ ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبِّي عَلَيۡهِ تَوَكَّلۡتُ وَإِلَيۡهِ أُنِيبُ ١٠ ﴾ [الشورا: ١٠]

“আর যে কোন বিষয়েই তোমরা মতবিরোধ কর, তার ফয়সালা আল্লাহর কাছে; তিনিই আল্লাহ, আমার রব; তাঁরই উপর আমি তাওয়াক্কুল করেছি এবং আমি তাঁরই অভিমুখী হই"[সূরা : আশ্-শূরা: ১০]

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَأُوْلِي ٱلۡأَمۡرِ مِنكُمۡۖ فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلًا ٥٩ ﴾ [النساء: ٥٩]

“হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর"[সূরা : আন্-নিসা: ৫৯]

সুতরাং সব বিরোধীদের উপর আবশ্যক হলো মতবিরোধের সময় কুরআন ও সুন্নাহের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার উপর কোন মানুষের কথা গ্রহণযোগ্য নয়। সত্য যখন প্রকাশিত হয়ে যায় তখন বিরোধীদের কথা দেয়ালের ওপারে ছুঁড়ে ফেলতে হবে, বিরোধী ব্যক্তিরা দ্বীন ও জ্ঞানে যত বড়ই হোক না কেন। কেননা মানুষ ভুল করতেই পারে। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথায় ভুলের কোন সম্ভাবনাই নাই।

আমাকে খুবই ব্যাথিত করে যখন দেখি অনেকে খুব আন্তরিকতার সাথে সত্য অনুসন্ধান ও সত্য পথে পৌঁছতে চেষ্টা করে। এতদসত্ত্বেও তাদেরকে বিচ্ছিন্ন ও নানা দলে বিভক্ত দেখি। তাদের প্রত্যেকের রয়েছে নির্দিষ্ট নাম ও বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতপক্ষে এটা ভুল। আল্লাহর দ্বীন একটি, ইসলামী উম্মাহ একটি। আল্লাহ বলেছেন,

﴿ وَإِنَّ هَٰذِهِۦٓ أُمَّتُكُمۡ أُمَّةٗ وَٰحِدَةٗ وَأَنَا۠ رَبُّكُمۡ فَٱتَّقُونِ ٥٢ ﴾ [المؤمنون: ٥٢]

“তোমাদের এই দীন তো একই দীন। আর আমি তোমাদের রব, অতএব তোমরা আমাকে ভয় কর"[সূরা : আল-মুমিনূন: ৫২]

আল্লাহ তাঁর নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,

﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ فَرَّقُواْ دِينَهُمۡ وَكَانُواْ شِيَعٗا لَّسۡتَ مِنۡهُمۡ فِي شَيۡءٍۚ إِنَّمَآ أَمۡرُهُمۡ إِلَى ٱللَّهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُم بِمَا كَانُواْ يَفۡعَلُونَ ١٥٩ ﴾ [الانعام: ١٥٩]

“নিশ্চয় যারা তাদের দীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের কোন ব্যাপারে তোমার দায়িত্ব নেই। তাদের বিষয়টি তো আল্লাহর নিকট। অতঃপর তারা যা করত, তিনি তাদেরকে সে বিষয়ে অবগত করবেন"[সূরা : আল-আন'আম: ১৫৯]

আল্লাহ আরো বলেছেন,

﴿ ۞شَرَعَ لَكُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِۦ نُوحٗا وَٱلَّذِيٓ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ وَمَا وَصَّيۡنَا بِهِۦٓ إِبۡرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰٓۖ أَنۡ أَقِيمُواْ ٱلدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُواْ فِيهِۚ كَبُرَ عَلَى ٱلۡمُشۡرِكِينَ مَا تَدۡعُوهُمۡ إِلَيۡهِۚ ٱللَّهُ يَجۡتَبِيٓ إِلَيۡهِ مَن يَشَآءُ وَيَهۡدِيٓ إِلَيۡهِ مَن يُنِيبُ ١٣ ﴾ [الشورا: ١٣]

“তিনি তোমাদের জন্য দীন বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন; যে বিষয়ে তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর আমি তোমার কাছে যে ওহী পাঠিয়েছি এবং ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হল, তোমরা দীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না। তুমি মুশরিকদেরকে যেদিকে আহবান করছ তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়; আল্লাহ যাকে চান তার দিকে নিয়ে আসেন। আর যে তাঁর অভিমুখী হয় তাকে তিনি হিদায়াত দান করেন"[সূরা : আশ্-শূরা: ১৩]

এটা যেহেতু আল্লাহর বিধান, তাই আমাদেরকে এ বিধান মেনে চলা ফরয। আমাদেরকে এক কাতারে সমবেত হতে হবে। সংশোধনের উদ্দেশ্যে আমরা পরস্পরে পর্যালোচনা করব। নিছক সমালোচনা ও প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে আমরা সমালোচনা করব না। কেননা যে ব্যক্তি নিজের মতের বিজয় ও অন্যের রায়কে তুচ্ছ করার বা সংস্কারের নিয়াত না করে নিছক সমালোচনার উদ্দেশ্যে বিতর্ক করে সে অধিকাংশ সময়ই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির পথ থেকে দূরে সরে যায়। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে আমাদের উচিত এক উম্মত হওয়া। আমি একথা বলছি না যে, কেউ ভুল করে না। সকলেই ভুল ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এসব ভুলের সংস্কার করাই মূল উদ্দেশ্যে। কারো অনুপস্থিতিতে তার সমালোচনা করে ভুলের সংশোধন করা যায় না, বরং এতে তার সম্মানহানি করা হয়। সংশোধনের পথ হলো তার সাথে একত্রিত হয়ে আলোচনা করা। আলোচনার পরে যদি প্রকাশ পায় যে, লোকটি তার ভুলের উপর বাড়াবাড়ি করছে এবং সে বাতিলের উপর আছে তখন সে নিজের ও সত্যের কাছে ওজর পেশ করবে। তবে তার উপর ফরয হলো ভুলকে প্রকাশ করা ও মানুষকে এ সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা। এভাবে ভুল সংশোধন হবে। অন্যদিকে বিভেদ ও দলাদলি কারো উপকারে আসবে না, বরং ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুদের কাজে আসবে।

আমরা আল্লাহ তা'আলার কাছে এ প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদের অন্তরকে তাঁর আনুগত্যের উপর একত্রিত করেন, তিনি যেন আমাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান মত ফয়সালা করার তাওফিক দান করেন। আমাদের নিয়াতকে বিশুদ্ধ করেন এবং তাঁর শরি'য়াতের অস্পষ্ট বিষয়গুলো তিনি যেন আমাদের নিকট স্পষ্ট করে দেন। নিশ্চয় তিনি দানশীল ও মহানুভব।

والحمد لله رب العالمين وصلى وسلم على نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين.

সব প্রশংসা মহান আল্লাহর, সালাত ও সালাম আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ ও সব সাহাবীদের উপর বর্ষিত হোক।



[1] বুখারী, হাদীস নং ১৪৯৬, মুসলিম, হাদীস নং ১৯।

[2] বুখারী, হাদীস নং ২৬৮০, মুসলিম, হাদীস নং ১৭১৩।

[3] বুখারী, হাদীস নং ৭।

[4] বুখারী, হাদীস নং ৬০২৫।

[5] মুসলিম, হাদীস নং ৫৩৭।

[6] তিরমিযি, হাদীস নং ২৬১৬।

[7] বুখারী, হাদীস নং ৬৭০৯, মুসলিম, হাদীস নং ১১১১।

[8] মুসলিম, হাদীস নং ২০৯০।

[9] মুসনাদে আহমাদ: হাদীস নং ১৫১৯২।

[10] বুখারী, হাদীস নং ৭৩৫২, মুসলিম, হাদীস নং ১৭১৬।